বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
একটা ফালতু প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি।
আচ্ছা,জাতি মানে কী?
বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে একটা ঢুঁ মেরে যে অর্থগুলো পেলামঃ
- জন্ম ও উৎপত্তি বিচারে সমলক্ষণ বিচারে শ্রেণিবিভাগ (মানব জাতি,পশু জাতি)
- ধর্ম অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ (মুসলিম জাতি,হিন্দু জাতি)
- রাষ্ট্র,দেশ বা সংস্কৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ (ফরাসি জাতি,জার্মান জাতি,বাঙালি জাতি)
- ব্যবসায় ও আচারগত জাতি (জাতিতে মুচি বা গোয়ালা)
- Race বা মানব জাতির বিভিন্ন শাখাগত বিভাগ (আর্য জাতি,মঙ্গোলীয় জাতি)
- গোত্র বা কুলগত বর্ণভেদমূলক সামাজিহ উপবিভাগ (কায়স্থ জাতি,বৈদ্য জাতি)
- শ্রেণি বা প্রকার (সাহিত্যের নানা জাতি)
উপরের অর্থগুলো থেকে একটা ধারণা স্পষ্ট যে জাতি শব্দটার দ্বারা,কীভাবে একজন মানুষকে define করা হয়,তা সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল।
বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে,জাতি শব্দটা দ্বারা আমরা দুইভাবে একজন মানুষকে define করতে পারিঃ
- তিনি কোন দেশের নাগরিক।
- তিনি কোন ধর্মের অনুসারী।
যদিও বর্তমানে ধর্মের বদলে দেশীয় পরিচয়ই মুখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তো এতক্ষণ আমরা,অর্থ্যাৎ মানুষরা,generally কীভাবে জাতি শব্দটা ব্যবহার করি,তা দেখলাম। এবার একটু দেখে আসি,ইসলাম উম্মাহ বা জাতি শব্দটা দ্বারা কীভাবে একজন মানুষকে define করে।
শাইখ আবদ আল-ওয়াহহাব আল-তুরাইরি বলেন,
ইসলামে উম্মাহ বা জাতি দ্বারা দুই ধরণের মানুষকে বোঝানো হয়েছেঃ
১) যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং ইসলামের আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণভাবে মেনে চলেন,অর্থ্যাৎ প্র্যাকটিসিং মুসলিম (Ummah of response)
২) যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন নি,অথবা গ্রহণ করেছেন কিন্ত পরিপূর্ণভাবে মেনে চলেন না,অর্থ্যাৎ নন-প্র্যাকটিসিং মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলবম্বী (Ummah of invitation)
বিস্তারিত ফতোয়াটি এখানে দেখুন।
ব্যাখ্যার সুবিধার্থে,আমরা নন-প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের বাদ দিয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বলি "Ummah of invitation"।
অর্থ্যাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে,জাতি simply দুইটিঃ
- মুসলিম
- অমুসলিম
কে কোন দেশের,কে কোন সম্প্রদায়ের,তার কোন কিছুই এখানে ধর্তব্য নয়।
বিদায় হজ্বের ভাষণে,ঠিক এই কথার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কণ্ঠেঃ
তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর দরবারে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী,যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে,সব বিষয়ে আল্লাহর কথা অধিক খেয়াল রাখে। ইসলামে জাতি,শ্রেণীভেদ ও বর্ণবৈষম্য নেই। আরবের উপর কোন অনারবের,বা অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদার ভিত্তি কেবল তাকওয়া।
এ ছাড়াও আমরা পাইঃ
আমার সমগ্র উম্মাহ একটি দেহের ন্যায়। যদি সেই দেহের কোন একটি অঙ্গ ব্যথা পায়,তাহলে তার ব্যথায় সারা শরীর ব্যথিত হয়। (মুসলিম)
তো,আমরা বুঝতে পারলাম,সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এক জাতি। তার মানে,ইসলামের যে কোন আদেশ,১৪৫০ বছর আগের একজন মদীনাবাসীর উপর যে রকম প্রযোজ্য ছিল,বর্তমানের একজন সৌদি আরবের মুসলমানের উপর,একজনের মিসরের মুসলমানের উপর,একজন বাংলাদেশের মুসলমানের উপরেও ঠিক তেমনি ভাবে প্রযোজ্য।
এবার একটু অন্যদিকে যাই।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনাতে আগমন করলেন তখন মদীনা বাসীদের দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু দিনের কি তাৎপর্য আছে? মদীনা বাসীগণ উত্তর দিলেন : আমরা মূর্খতার যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।’[ আবু দাউদ : ৯৫৯]
প্রশ্ন হচ্ছে,ঈদ মানে কী?
ঈদ আরবী শব্দ। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বার বার ফিরে আসে। এটা আরবী শব্দعاد يعود থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ ফিরে আসা। অনেকে বলেন এটা আরবী শব্দ العادة আদত বা অভ্যাস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বার বার ফিরে আসে তাই এর নাম ঈদ। এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ দিবসে তার বান্দাদেরকে নেয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বার বার ধন্য করেন ও বার বার তার এহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রমজানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। ছদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানীর গোশত ইত্যাদি নেয়ামত তিনি বার বার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নেয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগত ভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।
এই লাইনটার দিকে আবার তাকাইঃ
এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বার বার ফিরে আসে।
অর্থ্যাৎ যে কোন বার্ষিক উৎসব,যে দিনে মানুষ সবাই মিলে আনন্দ-ফূর্তি করে,একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানায়,তারই নাম হচ্ছে ঈদ।
আর উপরের হাদীস থেকে এটা স্পষ্ট,মুসলিমদের ঈদ দুইটি,শুধুই দুইটিঃ
- ঈদুল ফিতর
- ঈদুল আযহা
আর উপরের আলোচনা থেকে আমরা এটাও বলতে পারি,এই দুইটি ঈদের বাইরে আর কোন উৎসব যেমন মদীনা বাসীদের উপর নিষিদ্ধ করা হয়েছিল,ঠিক তেমনি ভাবে তা আমাদের জন্যও নিষিদ্ধ।
এতগুলো কথা বলার মূল উদ্দেশ্যটা এখন বলিঃ
ভাই/আপু,
আপনি সারা জীবন ধরে কুরআন-হাদীস ঘেঁটে যান,একটা কুরআনের আয়াত বা একটা হাদীসও পাবেন না যেখানে দেখবেন যে হিজরী নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবাগণ,যাঁরা মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠতম অংশ,তাঁরা হিজরী নববর্ষ পালন করেছেন।
যেখানে হিজরী নববর্ষ পালনেরই কোন নজির ইসলামে নেই,সেখানে এই ইংরেজি নববর্ষ পালন কতটুকু যৌক্তিক?
এই নববর্ষ পালন,নতুন বছরের দিনে "শুভ নববর্ষ" বা "Happy New Year" বলে wish করা,এগুলো সব কাফিরদের সংস্কৃতি।
রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,যেখানে পেরেছেন,যেভাবে পেরেছেন,কাফিরদের imitate করা থেকে মুসলিমদের বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।
যেমন মুসলিম পুরুষদের দাঁড়ি বড় করা ও গোঁফ ছোট রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,যেন মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্যতা না থাকে [বুখারী,মুসলিম]।
ঠিক একই কারণে,আশুরা অর্থ্যাৎ মহররমের ১০ তারিখে রোজার সাথে ৯ তারিখে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম,যেন ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না হয়ে যায় [মুসলিম,সিয়াম,হাদীস নং ২৬৬১]।
এরপরও যদি আপনি না মানেন,আমার বলার কিছুই নেই। কিন্ত এই হাদীসটা একটু মাথায় রাখতে বলবঃ
সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। [আবু দাউদ ৩৫১২]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,
এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হল, যে কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে সে কাফের হয়ে যাবে। যদি এ বাহ্যিক অর্থ (কুফরীর হুকুম) আমরা না-ও ধরি তবুও কমপক্ষে এ কাজটি যে হারাম তাতে সন্দেহ নেই। [আবু দাউদ ৩৫৭৪]
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য জানা,বোঝা ও মানার তাওফিক দান করুন।
আমীন।

No comments:
Post a Comment