Tuesday, March 5, 2013

ভালবাসার এপিঠ-ওপিঠ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।

ছোটবেলায় কমিকসের ভীষণ ভক্ত ছিলাম। কলকাতার ডায়মন্ড কমিকসের চাচা চৌধুরী,বিল্লু,পিংকি,রমন - কত যে কিনেছি আর কত পড়েছি,তার কোন হিসেব নেই।

তো রমনের কমিকসের একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। একদিন রমনের বাসায় একজন সেলসম্যান আসল। রমন তখন অফিসে। রমনের বউ কমলা যখন দরজা খুললেন,তখন সেলসম্যান বলল,"আমাদের চমৎকার রঙ ফর্সাকারী ক্রিম,মাত্র ৫০ টাকা। একবার লাগান আর ফিল্মস্টার হয়ে যান।"!

মেয়েমানুষ মাত্রই ফর্সা চামড়ার প্রতি দুর্বল। তো কমলা,যথেষ্ট পরিমাণ ফর্সা হওয়া সত্ত্বেও ঐ ক্রিম কিনতে চাইলেন এবং টাকা আনতে বাসার ভিতরে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে রমন বাসায় ফিরে এলেন এবং গেটের বাইরে সেলসম্যানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোজা বেরিয়ে যেতে বললেন। কমলা দৌড়ে এসে ঐ সেলসম্যানকে আটকালেন আর বললেন যে তিনি ক্রিম কিনবেনই। রমন যখন বললেন,"তুমি এই ক্রিম কিনতে পারবে না।",কমলা বললেন,"তুমি অন্তত একটা কারণ দেখাও কেন আমি ক্রিমটা কিনব না",তখন রমন বললেন,

"ওর রঙ ফর্সাকারী ক্রিম সত্যিই যদি রঙ ফর্সা করত,তাহলে ও নিজে এত কাল কেন?"
এবং ঐ সেলসম্যান আসলেই কাল ছিল!

কখনো কখনো শুধুমাত্র একটা কারণই যথেষ্ট হয়ে যায়। ৯৯%-এর বদলে ১%-ই তখন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।

তো এখন মূল কথায় আসি।

আমাদের চারপাশে ভালবাসার ছড়াছড়ি। গানে ভালবাসা,নাটকে ভালবাসা,সিনেমায় ভালবাসা,বিলবোর্ডে ভালবাসা! টেলিভিশন,রেডিও খুললেই ভালবাসা। এমন কি আমি যখন এই নোটটা লিখছি,আমারই পাশের কোন এক বাসায় লাউডস্পিকারে ভালবাসার গান হচ্ছে,আর আমি ধৈর্যের চরম পরিচয় দিয়ে (নিরুপায় হয়েই) সেই গান কর্ণকুহরে প্রবেশ করাচ্ছি। সদ্যপ্রয়াত হূমায়ূন আহমেদের ভাষায়," হে বাঙ্গালী জাতি,প্রেম কর,প্রেম। হে বাঙ্গালী জাতি প্রেমে ধর হাত মম।"

তো এই যাঁরা আমাদের প্রেমের প্রতি নিয়মিত আহবান জানাচ্ছেন,গায়ক/গায়িকা গানের মাধ্যমে,অভিনেতা/অভিনেত্রী অভিনয়ের মাধ্যমে,মডেল মডেলিং-এর মাধ্যমে,আরজে/ভিজে (বাংলা ভাষায় উপস্থাপক) উপস্থাপনার মাধ্যমে,আমরা তো এটুকু আশা করতেই পারি,যে তাঁরা নিজেরা ভালবাসার মানে বুঝেছেন,এবং ভালবাসাকে নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছেন,তাই না?

চলুন একটু দেখে আসি,তাঁদের জীবনে ভালবাসার কী অবস্থা?

এটা কারো অজানা নয় যে "সেলিব্রিটি কাপল" মানেই হল ভাঙ্গাগড়ার সংসার। কিছুদিন একসাথে থাকা,তারপর ইচ্ছা হলেই সাজানো-গোছানো সংসারটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। উদাহরণস্বরুপ আছেন সুবর্ণা মুস্তাফা-হূমায়ূন ফরিদী,তিন্নী-হিল্লোল,কেট মস-ব্র্যাড পিট প্রমুখ (লিস্ট বাড়াতে থাকলে এই নোট আর শেষ হবে না!)।

আর একেবারে গরম খবর তো আমাদের বিখ্যাত সঙ্গীতপরিচালক ইমনের। এক বছর একটা মেয়েকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ঘরে একদম স্ত্রীর মত রাখা,তার শরীরের যাবতীয় সুধা উপভোগ করা,তারপর যখন সাধ মিটে গেল,মেয়েটার নগ্ন ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাকে বের করে দেওয়া,সবশেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে তাকে বিয়ে করা - এরই নাম ভালবাসা?

এই খবরটা তো তাও exposed হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এভাবে কত জীবন ঝরে গেছে,নষ্ট হয়েছে,কে বলতে পারে?

এই সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত জীবন যে কী পরিমাণ নোংরা,একজন চোখ-কান-নাক খোলা সাধারণ মানুষ মাত্রই জানেন।

তো এখানেই আমার প্রশ্ন,

যাদের গান শুনে,যাদের ছবি দেখে,যাদের অভিনয় দেখে,আমরা মনে করছি যে একটা মেয়ে/একটা ছেলেই আমাদের জীবনের সবকিছু,তার ভালবাসা ছাড়া আমাদের জীবন ব্যর্থ,তাদের ব্যক্তিগত জীবনটার দিকে একবার তাকিয়ে কেন দেখি না আমরা? কেন আমদের মনে আসে না,তাদের কথাগুলো যদি সত্যি হত,তাদের ভালবাসার definition যদি আসলেই perfect হত,তাহলে তাদের ব্যক্তিগত জীবন এতটা নোংরা কখনোই হত না? তাদের দেওয়া ভালবাসার সংজ্ঞা যদি সত্যিই হত,তাহলে কেন তাদের নিজেদের জীবনই লণ্ডভণ্ড? রমনের সেই একটা প্রশ্নের মত,এই একটা প্রশ্নই কি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে আসল দৃশ্যটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?

প্রসঙ্গত,নিজের জীবনের একটা experience বলতে চাই।

স্টার জলসা নামে একটা কলকাতার বাংলা চ্যানেল আছে। সেই চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম,নাম মনে নেই। তবে অনুষ্ঠানটা ছিল বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যে মান-অভিমান হয়,তার ফলে একে অপরের  কাছ থেকে তাঁরা দূরে সরে যান,তাঁদের মধ্যে মিল করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে। উপস্থাপনা করছিলেন ওপার বাংলার বিখ্যাত অভিনেত্রী কোয়েল মিত্র।

তো সেই পর্বে এসেছিল একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটার বয়স ১৯,মেয়েটার ১৮। পালিয়ে গিয়ে দুইজন বিয়ে করে এবং নিজেরাই ঘর-সংসার চালানোর দ্বায়িত্ব নিতে চায়। যেহেতু সিনেমা আর লাইফ এক না,তাই ছেলেটা আর সংসারের ঘানি টানতে না পেরে একপর্যায়ে তার বউকে ফেলে পালিয়ে যায়। মেয়েটা অনেক খুঁজেও তার স্বামীকে না পেয়ে শেষমেষ ওই অনুষ্ঠানের আশ্রয় নেয়,এবং অনেক দিন পর তারা এক হয়।

যাই হোক,তো কথাবার্তার একপর্যায়ে কোয়েল ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেন,"যদি সংসারের ঘানি টানতে না পার,তাহলে বিয়ে করলে কেন?"। ছেলেটার সরল উত্তর,"আপনাদের ছবি দেখে দেখে মনে করেছিলাম যে ভালবাসার শক্তি দ্বারা সব জয় করা সম্ভব!"। কোয়েল এরপর যে উত্তর দিলেন,তাতে আমি হাসব,না কাঁদব,কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না!

কোয়েলের উত্তরঃ

"তোমরা কেন দুই-তিন ঘণ্টার একটা ছবিকে জীবনের সমতুল্য মনে কর? ছবি তৈরি করা হয় তোমাদের এন্টারটেইমেন্টের জন্য! ছবি দেখে আনন্দ নিবে,ফুর্তি করবে,ব্যস ফুরিয়ে গেল!"

ওয়াও!

নিজেরা ছবিতে দেখাচ্ছেন,শিখাচ্ছেন,প্রেম স্বর্গ থেকে আসা অমূল্য রত্ন,প্রেমই জীবনের একমাত্র সত্য,প্রেমের কাছে জীবনের সকল বাধা তুচ্ছ।

যৌবনের স্বাভাবিক আবির্ভাবে একটা ছেলে বা একটা মেয়ে যখন এমনিতেই বিপরীত লিঙ্গের একজন সঙ্গীর জন্য পাগল,তখন তারা কোয়েলদের দেখে শিখছে,প্রেমে পড়লে একটা ছেলে হয়ে যায় সুপারম্যান,আর একটা মেয়ে হয়ে যায় ওয়ান্ডার ওম্যান! পৃথিবীর কোন বাধাই তাদের কাছে আর কোন বাধা থাকে না,"ভালবাসা" নামক কোন এক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় এরা হয়ে ওঠে অসীম শক্তির অধিকারী!!!

কিন্ত এরকম কোন মর্মস্পর্শী বাস্তব ঘটনা কোয়েলদের সামনে আসে,তখনই গলার সুর পালটে তাঁরা বলে ওঠেন,"আরে এটা তো শুধু এন্টারটেইমেন্ট!"।

এইরকম কিছু এন্টারটেইমেন্টের কাছেই শেষ হয়ে যায় অগণিত মুসলিম যুবক-যুবতীর সুন্দর ভবিষ্যৎ।

যাই হোক,শেষ করার আগে,একটা গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই। না,ঠিক গল্প বললে ঠিক হয় না,বরং বলি,"লাভ স্টোরি"।

তাঁরা বিয়ে করলেন। না,বিবাহপূর্ব প্রেমপ্রীতি ভালবাসা নয়,ঠিক যেভাবে ইসলাম আদেশ করেছে,একেবারেই সেভাবে।

বিয়ের পরে,তাঁরা একে অন্যের সান্নিধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন। না,ভালবাসার কোন কমতি তাঁদের মধ্যে ছিল না। তাঁরা একে অপরকে আগলে রাখলেন,ঠিক সেভাবে,যেভাবে দুই অর্ধ একসাথে যোগ হয়ে এক তৈরি করে।

তাঁরা নানাভাবে একে অন্যের সান্নিধ্য উপভোগ করতে লাগলেন। কখনো কখনো তাঁরা একে অন্যের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত করতেন! স্বামী ইচ্ছে করেই হেরে যেতেন,কারণ তাঁর স্ত্রীর উচ্ছল হাসিমুখ তাঁর কাছে বড়ই প্রিয়। আবার মাঝেমধ্যেই স্ত্রীর অভিমান বানানোর জন্য তাঁকে হারিয়ে দিতেন,কারণ স্ত্রীর অভিমান ভাঙ্গানোর আনন্দও যে অসাধারণ!

কয়েক বছর পর,স্বামী অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গেলেন,বোঝা গেল,তাঁর দিন শেষ হয়ে এসেছে। তারও কিছুদিন পর,স্বামী মারা গেলেন,স্ত্রীর হাঁটুর উপর মাথা রেখে। আর তাঁর কবর হল স্ত্রীর ঘরেই।

স্ত্রী এই ঘটনার পর,অনেক বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্ত তাঁর স্বামীকে এতটাই তিনি ভালবাসতেন,দ্বিতীয়বার কোন পুরুষের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকান নি। আর এভাবেই,জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর স্বামীর হয়েই ছিলেন।

"লাভ স্টোরি" এখানেই শেষ। স্বামী আর স্ত্রীর পরিচয় দেওয়ার আগে একটা তথ্য দিতে চাই।

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন,এই "লাভ স্টোরি"-র একটা কথাও কিন্ত আমরা স্বামীর মুখ থেকে জানতে পারি নি। প্রত্যেকটা বাক্য,প্রত্যেকটা ঘটনা,জেনেছি স্ত্রীর মুখ থেকে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার কি জানেন? তাঁর মুখ থেকে তাঁর স্বামী সম্পর্কে একটা খারাপ মন্তব্য পাওয়া যায় নি!

আমি আমার বোনদের হেয় করে কোন কথা বলছি না,কিন্ত আমরা জানি যে তাঁরা একটু বেশিই বিষোদগার করে থাকেন (স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস আছে এ ব্যাপারে)। আর বর্তমান কালে এমন কোন স্ত্রী আমি দেখি নি,যিনি তাঁর স্বামীর অন্তত একটা ব্যাপার নিয়ে কিছুটা হলেও বিরক্ত নন।

By the way,এই "লাভ স্টোরি" কিন্ত এখানেই শেষ না। সহীহ হাদীস থেকে সরাসরি প্রমাণিত,তাঁদের এই "লাভ স্টোরি" শেষ হয় নি,বরং এটা আবার শুরু হবে ইনশাআল্লাহ,এবং চলতেই থাকবে,জান্নাতে

এবার বলে দেই এটা কাদের "লাভ স্টোরি"।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আয়িশা রাযিআল্লাহু আনহা।

Isn't it the BEST love story anyone can ever tell?

আসুন,নিজেদের সংযত করি। স্ত্রোতের সাথে না মিশে গিয়ে এক আল্লাহর উপর নিজেদের পূর্ণ বিশ্বাস সঁপে দেই। তাঁর কাছে এমন একজন প্রার্থনা করি,যাঁর সাথে ঠিক এরকম একটা "লাভ স্টোরি" আমরা রচনা করতে পারব। যে "লাভ স্টোরি"-র চিত্রনাট্যে কোন একজনের মৃত্যুতে "THE END" লেখা পর্দা উঠবে না,বরং উঠবে,"TO BE CONTINUED IN JANNAH"!

No comments:

Post a Comment