বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম।
১.
টোনা খুবই নার্ভাস। আজ তার বিয়ে। দশ মাইল দূরের এক গ্রামে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে।
কলেজের
হোস্টেলে ছিল সে,তখনই এল টেলিগ্রামটা। বাবার নির্দেশ, টেলিগ্রাম পাওয়া
মাত্র যেন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। সেই মোতাবেক বাড়িতেও সে ভালভাবেই
পৌঁছে যায়। কিন্ত বাড়িতে পৌঁছেই সে একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পরে যায়।
সবাই তাকে দেখেই কেমন যেন ফিসফিস করছে! অবশেষে বাবার সাথে দেখা করতে এসে সে
জানতে পারে, বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছেন। মেয়ে দশ মাইল দূরের গ্রামের
ডাক্তার সাহেবের মেয়ে, ক্লাস এইট পাস।
বাবার আদেশের উপর কথা বলা বা তা অমান্য করা, কোনটারই সাহস নেই টোনার। তাই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, ঢেঁকি তাকে গিলতেই হচ্ছে!
কিন্ত
টোনা অনুভব করে, নার্ভাসনেসের সাথে সাথে আরো কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে
তার। রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্প পড়েছে সে আগেই। অপু যখন হৈমন্তীকে বিয়ে
করতে যায়, সেই সময়ে অপুর অনুভূতি,আর তার অনুভূতি, কীভাবে কীভাবে যেন মিলে
যাচ্ছে।
অবশেষে সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে টুনিকে নিয়ে
বাড়ি ফেরে টোনা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, যাকে আজকের আগে জীবনে একটাবারও দেখে
নি, তার জন্য এত মায়া, এত ভালবাসা কীভাবে জন্মাতে পারে! বারবার কেন মনে
হচ্ছে, “পাইলাম, আমি উহাকে পাইলাম!”
শুরু হল আমাদের
টোনাটুনির সংসার। টুনি গ্রামে, আর টোনা পড়াশুনার কারণে কলেজের হোস্টেলে।
কিন্ত দুজনের মন যেন সারাক্ষণ পরে থাকে দুজনের কাছে।
অবশেষে সরকারি চাকরি হল টোনার, সরকারি বাসা পেল সে। কালবিলম্ব না করে টুনিকে সে নিয়ে এল। নতুন এক যাত্রা শুরু হল দুজনের।
সময়
তার মত করে চলে যেতে থাকে। টোনাটুনির ঘর আলো করে আসে এক মেয়ে আর এক ছেলে।
সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে তারা চারজন একে অপরের হাত ধরে চলতে থাকে।
ছেলেমেয়ে বড় হল, প্রতিষ্ঠিত হল। আর টোনাটুনি হল বুড়োবুড়ি। আর তাদের সাথী হল তাদের তিন নাতী-নাতনি।
বয়সের
কারণেই টোনা এক সময় খুবই অসুস্থ হয়ে পরল। চারপাশ সম্বন্ধে পুরোপুরি হুঁশ
হারিয়ে যেন এক বাচ্চা ছেলে হয়ে গেল সে। নিজে নিজে খাওয়ার ক্ষমতাটুকুও
হারিয়ে ফেলল। আর বিছানায় শৌচকর্ম সারাতো রুটিনে পরিণত হল!
টুনি
নিজেও এখন বুড়ি, এত জ্বালা আর কাঁহাতকই সহ্য করা যায়? কিন্ত তারপরও, সব
বিরক্তি একপাশে ফেলে নিবিড়ভাবে টোনার সেবায় মনোনিবেশ করল সে।
অসুস্থতা
বেড়ে যাওয়ায় টোনার ঠাঁই হল হাসপাতালে। আর তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হল টুনি।
ডাক্তার দেখে বলে গেলেন, “আর খুব বেশিদিন তিনি আর আপনাদের বিরক্ত করবেন
না।“
এক-দেড় সপ্তাহ পরেই টোনার ডাক এসে গেল। আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে সে চলে গেল এই দুনিয়া ছেড়ে।
টুনি
ভেঙ্গে পড়ল। কিন্ত তার তিন নাতী-নাতনির দিকে তাকাতেই তার মনে হল, না, তার
ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। টোনার বংশধর তো এরাই। টুনি এদের না দেখলে, আর কে
দেখবে?
এখন টুনির দিন কাটে নাতী-নাতনিদের পরিচর্যায়,
তাদের দেখভালে। আর সেই দিনের প্রতীক্ষায়, যে দিন সে ইনশাআল্লাহ আবার টোনার
সাথে মিলিত হবে। দুজনে অনন্তজীবনের জন্য সংসার শুরু করবে,তাদের জন্য
নির্ধারিত জান্নাতের বাগানে।
২.
পাঠক, কেমন লাগল এই কাছে আসার গল্প?
এই
গল্পের রচয়িতা কিন্ত আমি নই! হ্যাঁ, গল্প লেখার জন্য কিছু কিছু কল্পনার
আশ্রয় নিয়েছি বটে, কিন্ত উপরের ঘটনাগুলো কিন্ত সত্যি। টোনাটুনিও সত্যি।
এই টোনা হচ্ছেন আমার নানা।
নিশ্চয় বুঝে গেছেন, টুনি হচ্ছেন আমার নানী।
আমার
বাবা-মা দুজনই চাকুরীজীবি। তাই ছোটবেলা থেকে নানা-নানীর কাছে বেড়ে ওঠা।
তাদের বিয়ের গল্প তাদের মুখেই শোনা। আর নানার শেষ দিনগুলোর বাস্তব সাক্ষী
আমি নিজে। নিজে দেখেছি, নানী নানার জন্য কতটা কষ্ট করছেন। কীভাবে আমার
“বুড়ো বাচ্চা” নানার সেবা করে যাচ্ছেন।
লক্ষ্য করে দেখুন,
তাঁদের এই কাছে আসায় কিন্ত বিয়ের আগের পরিচয়পর্ব ছিল না, রাতবিরেতে
ফোনালাপ বা চিঠি আদানপ্রদান ছিল না, লুকিয়ে লুকিয়ে পার্কে ডেটিংও ছিল না।
তারপরও কী চমৎকারভাবেই না জীবনের একটা বিরাট অংশ তাঁরা একে অপরের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দিলেন।
এটা যদি “ভালবাসা” না হয়,“কাছে আসা” না হয়, আমি জানি না ভালবাসা কাকে বলে, কাছে আসা কাকে বলে।
৩.
আসুন বর্তমান কালের “কাছে আসা”-গুলো একটু দেখে আসি।
একদিন এক বন্ধু এসে বললেন, “দোস্ত, নতুন একটা রিলেশনশিপে জড়াইলাম।“
আমি আর কী বলব? বললাম,“আচ্ছা আচ্ছা। তো এনাকে কি বিয়ে করার ইচ্ছা আছে না কি?”
বন্ধুটি বললেন, “এখন কীভাবে বলব? আরো একটু সামনে বাড়ুক, তারপর দেখি।“
দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম।
এক-দেড় মাস পরে জিজ্ঞাসা করলে বন্ধুটি জানান, সেই রিলেশনশিপ ভেঙ্গে গেছে!
৪.
আমি
খুব ভালভাবেই জানি,একদল প্রেমিক-প্রেমিকা লেখার এই অংশে এসে বলবেন, “জানি
একদল ছেলেমেয়ে এই রকম করে। তো সেটা সবাই করে না কি? প্রেম করে মানুষ কি
বিয়ে করে না?”
অবশ্যই করে, কেন করে না?
কিন্ত
আমি আমার এই জীবনে,এখন পর্যন্ত, কোন প্রেমের বিয়েকে এতটা সাকসেসফুল হতে
দেখি নি, বা শুনি নি, যে রকম সাকসেস আমি তথাকথিত “ব্যাকডেডেট” অ্যারেঞ্জ
ম্যারেজগুলোর ক্ষেত্রে দেখেছি।
আমার কথা না হয় উড়িয়ে দিলেন। ভাল কথা। কিন্ত গবেষণাও যে আমার কথাগুলো সাপোর্ট করে!
একজন ফ্রেঞ্চ সমাজবিজ্ঞানী কর্তৃক মাঠপর্যায়ে চালানো এক গবেষণায় উঠে এসেছে,
যখন দুই পক্ষ বিবাহ পূর্ব প্রেমের সম্পর্কে লিপ্ত হয় না তখন সে বিয়ের সফলতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।১
প্রফেসর ইসমাঈল আবদ’ আল বারি’ কর্তৃক প্রায় ১৫০০ পরিবারের ওপর চালানো অন্য এক জরিপের ফলাফল ছিল এমন যে শতকরা ৭৫ ভাগ “ভালবেসে বিয়ের
” পরিণতি ছিল ডিভোর্স যেখানে “প্রথাগত বিয়ের” ক্ষেত্রে শতকরা ৫ ভাগেরও কম।১
ঢাকা সিটি করপোরেশনে জমা পড়া বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনগুলোও ঘেঁটে দেখা গেছে,
তালাকের শীর্ষে প্রেমের বিয়ে!!!
৫.
“কাছে এস, কাছে এস, কাছে এস না।“
ক্লোজ আপের বিজ্ঞাপন সঙ্গীত।
বিজ্ঞাপনে
দেখানো হচ্ছে, এক তরুণ সকালে উঠে ক্লোজ আপ দিয়ে দাঁত মেজেছেন। যার ফলে
তাঁর দাঁত হয়েছে ধবধবে সাদা, নিঃশ্বাস হয়েছে সতেজ, তরতাজা।
ফলাফল,
তরুণ সুপারমার্কেটে প্রবেশের রিভলভিং দরজায় একজন তরূণীর নাকের সামনে তার
সতেজ নিঃশ্বাস ছেড়ে দেন, এবং এই নিঃশ্বাসের জেরেই তরূণী তরুণের প্রেমে পরে
যান!
প্রেম আর নারী, দুটোই কী সস্তা, আহা!
আর এই ক্লোজ আপই যখন “কাছে আসার গল্প” প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, হাসি ঠেকিয়ে রাখা ব্যাপক কষ্টকর হয়ে যায়!
৬.
মীর সাজ্জাদ ভাইয়ের একদিনের স্ট্যাটাস,
বিয়ের আগে......
প্রেমিক : আমি তোমাকে ভালবাসি ।
প্রেমিকা : আমিও তোমাকে ভালবাসি ।
শয়তান : আমি তোদের দুই জনকেই ভালবাসি।
রেফারেন্স : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
"যেখানে দুজন বেগানা নারী-পুরুষ নির্জনে একত্র হয় সেখানে তৃতীয়জন হয় শয়তান।"
-[জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১৭১]
বিয়ের পরে...... ...
স্বামী : আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি।
স্ত্রী : আমিও তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি।
> যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর নিষেধ-নির্দেশ মেনে জীবন পরিচালিত করে তাদেরকেও আল্লাহ ভালবাসেন ।
রেফারেন্স :
১ . হাদিসে কুদসীতে আছে মহান আল্লাহ বলেন: "আমার জন্য পরস্পর ভালোবাসা
স্থাপনকারী, পরস্পর উঠা-বসা-কারী, পরস্পর সাক্ষাৎকারী, পরস্পর ব্যয়কারীদের
জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত।"
[আহমদ:২১৭১৭]
২ .
"আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারীরা কোথায় ? আজ
- যে দিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না- আমি তাদের ছায়া দেব।"
[সহীহ মুসলিম : ৪৬৫৫]
শিক্ষা : বিয়েপূর্ব প্রেম শয়তানের জন্য এবং বিয়ে পরবর্তী প্রেম আল্লাহর জন্য তৈরি হয় ।
রেফারেন্স :
ইবন আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
"দুজনের পারস্পারিক ভালোবাসার জন্য বিবাহের মত ভাল কিছু নেই।"
[ইবন মাজাহ , ১৮৪৭]
কোন পথটা সত্যিকারের কাছে আসার পথ, আশা করি এর পরে আর বুঝতে বাকী থাকার কথা না।
৭.
টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনে শুনেছিলাম,
“আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে সবকিছুই হয়, কিন্ত একটু দেরিতে।“
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে এই কথাটা আমার ক্ষেত্রেও একদম খেটে যায়!
প্রতিবার যা কিছু বাবা-মার কাছে চেয়েছি, তাঁরা সবই দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ, কিন্ত একটু সময় নিয়ে।
আর
এতে দেখেছি, একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পর যে জিনিসটা আমি পাই, আশেপাশের
অনেকেও সেই জিনিস কিনলেও, কেন জানি আমার জিনিসটাই তাঁদের থেকে ভাল হয়!
আর
অন্য দিকে, যতবার তাঁদের অবাধ্য হয়েছি, জিদ করেছি “না,এক্ষুণি কিনে দিতে
হবে”, সেই জিনিসটা এমন খারাপ হয়, যে কিছুদিন পরই নিজের মন ওটা থেকে উঠে
যায়।
আমাদের একটু চিন্তা করা উচিত, আমাদের জীবনের সবচাইতে
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যদি আমরা আল্লাহর অবাধ্য হই, তাঁকে
পাশ কাটিয়ে নিজে নিজে সবকিছু ঠিক করে ফেলি, তাহলে কি হিতে বিপরীত হওয়ার
ঝুঁকিটাই বেড়ে যায় না?
পাদটিকা
১.
যে প্রেমের পরিণতি বিয়ে- সেটা কি হারাম?